ওরা অকারণে চঞ্চল …

প্রতি বছর ২২শে মে বিশ্বব্যাপী পালিত হওয়া আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস” এর তাৎপর্য্য বিশ্লেষণ করেছেন সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। 

খানিক আগে এক পশলা বৃষ্টি এসে ধুইয়ে দিল আমার বাগানের গাছগুলোর গরমে তেতে থাকা রুখো শরীরগুলোকে। অনেক দিন পর আপন খুশিতে একসাথে নেয়ে উঠলো ওরা সবাই। ধুলোমাখা পাতা আর শরীর একটু সাফসুতরো হতেই কেমন শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে মেঘ দেবতা বরুণ দেবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিল গাছেরা। আমারও মন চাইছিল ওদের মতো করে শরীর ভিজিয়ে স্নান করতে। মন চাইলেও আজকাল শরীর আর সেভাবে সায় দেয় না। সময়ের সাথে সাথে যেন ক্রমশ স্থবির, অশক্ত হয়ে আসছে শরীর। তাই খোলা জানালার সামনে বসে থেকেই অনেকটা সময় কেটে যায় আমার। 

গরাদের ওপারে আমার ছোট্ট বাগানে অবশ্য ওরা সকলেই নিজের নিজের কাজে ব্যস্ত থাকে। রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতির দল সবসময় ব্যস্ত। চকচকে লাল কোটের ওপর ছোট ছোট কালো বুটি দেওয়া লেডি বার্ড বিটলরা এফিডের সন্ধান করে,ফিনফিনে ডানাওয়ালা ফড়িংয়েরা ঠিক যেন হেলিকপ্টার, এই ওঠে তো ওই নামে, ঝাঁক বেঁধে বাগানের মাটিতে নেমে থপথপিয়ে চড়ে বেড়ানো পাটকেল রঙের ছাতারে পাখিরা, কালো সাদা আর বাহারি লালের ছোপ লাগানো বুলবুলিরা সবাই বেজায় ব্যস্ত, এর‌ই মাঝে এসে হয়তো হাজির হয়েছে এক জোড়া বেনে বৌ- টকটকে হলুদ পালকে ঢাকা শরীরে আশ্চর্য কালো রঙের রূপটান তাদের, চোখ ফেরানো যায়না। আছে আরও আরও অনেকে। 

সবার কথা ক‌ইতে বসলে যে বেলা বয়ে যাবে! অত সময় কোথায়? ওদের দেখে দেখেই দিব্যি সময় যায় গড়িয়ে। আসলে আমিও যে ওদের‌ই অংশ,তাই হয়তো খুব সচেতনভাবে ওদের সাথে জড়িয়ে থাকতে ভারি ভালো লাগে। সারাদিন,সারা বছর, সারা জীবন এভাবেই ওদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখা — এক অনির্বচনীয় ভালোলাগায় ভরে রাখে আমাকে, আমিও যে ঐ বিচিত্র প্রাণের অংশীদার। ওদের মতোই অকারণে চঞ্চল।”

চারিদিকে দেখো চাহি নয়ন প্রসারি …

গুপি গাইন গান বেঁধেছে — দেখোরে নয়ন মেলে, জগতের কি বাহার! সত্যিই তো কি সুন্দর আমাদের প্রিয় বাসভূমি, আমাদের প্রিয় ধরিত্রী। তাঁর মাঠ ঘাট, পাহাড় পর্বত, নদী নালা,বন প্রান্তর। আমাদের ঘিরে থাকা কত বিচিত্র প্রাণের মেলা। কত বিচিত্র বৃক্ষরাজি, লতাপাতা, ফুল ফল, কীট পতঙ্গ পশু পাখি । সবেতেই কি অপার বৈচিত্র্য , প্রাণের কি বিস্ময়কর ভাণ্ডার, কত বৈভবী তার আয়োজন ! এই বিভিন্নতা শুধু একটি একক প্রাণের মধ্যেই সীমিত এমনটাতো নয় একের মধ্যেই রয়েছে শতেক প্রাণের বৈচিত্র্যময় আভাস। 

প্রাণের এতো বিভিন্নতা, এতো বৈচিত্র্য তা যে প্রাণ পরিবেশের ব্যাপক বৈচিত্র্যেরই প্রতিফলন। এই রূপগত বিভিন্নতাকে অবলম্বন করেই মানুষের বেড়ে ওঠা, সভ্যতার পত্তন ও তাকে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। আসলে একটা নিবিড় শৃঙ্খলার বাঁধনে আমরা সবাই বাঁধা পড়ে আছি। আর আছি বলেই না পৃথিবী এতো সুন্দর! এই বিশ্বভরা প্রাণের মেলায় নিজেকে একান্ত রূপে খুঁজে পাওয়ার মধ্যেই যে জীবনের সার্থকতা। এতো বৈচিত্র্য আছে বলেই না পৃথিবী এতো সুন্দর, মোহময়।

এই বৈচিত্র্যময় প্রাণ পরিবেশের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। মানুষের জৈবনিক অস্তিত্বের জন্য যা কিছুর প্রয়োজন , তাঁর বেঁচে থাকার অর্থবহ রূপায়ণে যা কিছু সহায়ক , মানুষের মননের নান্দনিক সৌন্দর্যের বিকাশ — সবকিছুই যে মেলে ওই প্রাণ পরিবেশের উপাদানগুলো থেকে। নদী নালা সমুদ্রের মাছেরা মেটায় সহজপাচ্য প্রোটিনের চাহিদা, সবুজ গাছপালা আর লতাপাতার থেকে আমরা পাই আমাদের আহার্যের প্রায় ৮০ শতাংশ উপকরণ। 

পৃথিবীর নানান মহাদেশের গ্রামীণ মানুষেরা এখনও তাঁদের আধিব্যধির নিরাময়ের জন্য নির্ভর করে থাকে অরণ্যের লতাগুল্মের ওপরে। পারস্পরিক সম্পর্কের এক আশ্চর্য মিথষ্ক্রিয়া বহমান রেখেছে পৃথিবী ব্যাপী পরিব্যাপ্ত এই বিপুল প্রাণের বৈচিত্র্যময় অস্তিত্বকে। মানুষের এতো কালের যে সভ্যতা তা তো গড়ে উঠেছে ঐ বিচিত্র প্রাণের অপার সম্পদকে আশ্রয় করেই। তাই তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য‌ই জীববৈচিত্র্য দিবস পালন। 

উদযাপনের ইতিকথা 

২২ মে — প্রতি বছর এই দিনটিকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। কবে থেকে এই পর্বটি শুরু হলো তা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৮৫ সালে অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে। ঐ বছরই Walter G. Rosen খানিকটা বড়োসড়ো চেহারার শব্দকে কেঁটে ছেঁটে এখন প্রচলিত বায়ো ডাইভার্সিটি শব্দবন্ধটিকে বিজ্ঞানী মহলে প্রচলিত করেন। পৃথিবীর প্রাণিকুল একান্তভাবেই কতগুলো বাস্তুতন্ত্রের অধীন। বাস্তুতন্ত্র হলো একটি শৃঙ্খলা যা পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা যদি জীবনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হয় তাহলে বলতে হয় যে জীববৈচিত্র্য বাস্তুতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত ভাবে আরও বর্ণিল করে তুলেছে। তবে প্রাণের এই বিচিত্র আয়োজন কখনোই বিশৃঙ্খল নয়, বরং বলা যায় যে তার বিন্যাস একান্ত ভাবেই পরিবেশানুগ।

১৯৮৮ সালে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম বা UNEP র উদ্যোগে জীববিজ্ঞানীদের এক কনভেনশন বা সম্মেলন আহ্বান করা হয় যার উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য ছিল পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের সংরক্ষণের বিষয়ে যথোপযুক্ত নীতি নির্ধারণ করা যা পরবর্তীতে সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে এই উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশ করতে পারবে। ১৯৯৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ইউনাইটেড নেশন্সের সাধারণ সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহকে বিধিসম্মত ভাবে কার্যকর করার কথা ঘোষণা করে। বর্তমানে এই গোষ্ঠী সমন্বয়কে কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি বা (CBD) হিসেবে অভিহিত করা হয়।

বস্তুতপক্ষে CBD হলো পার্থিব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি যা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর পক্ষে অনুসরণীয়। এই চুক্তি সনদে বলা হয়েছে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্যের অনন্য জেনেটিক উপাদানগুলোকে টেকস‌ইভাবে ব্যবহারের ফলে যে জ্ঞান বা উপযোগিতা পাওয়া যাবে তার সমান অংশীদার হবে সদস্য রাষ্ট্রগুলো, বর্তমানে যার সদস্য সংখ্যা ১৯৬। এই চুক্তির মাধ্যমে প্রায় বিশ্বজনীন সহযোগিতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। আজ এই আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতান্ত্রিক পরিষেবা সংক্রান্ত যে কোনো রকমের বিপর্যয়ের আশঙ্কাকে অত্যন্ত কার্যকরভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছে।

২০০০ সালে সংযুক্ত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদের পক্ষ থেকে মে মাসের ২২ তারিখটিকে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস (IDB) হিসেবে পালন করার কথা ঘোষণা করা হয়। ১৯৯২ সালের ২২মে তারিখে CBD র পক্ষ থেকে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে প্রথম খসড়া প্রস্তাবটি গ্রহণ করা হয়েছিল। তাই ঐ দিনটিকেই সর্বসম্মতিক্রমে বেছে নেওয়া হয়। আজ পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে এই সিদ্ধান্তর অংশীদার হিসেবে। একসূত্রে সবাইকে বেঁধে রাখার ক্ষেত্রে সন্দেহাতীতভাবে এ এক প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই ঐতিহাসিক উদ্যোগের কল্যাণে আজ পৃথিবীর বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রকে জীববৈচিত্র্য হট স্পট হিসেবে সংরক্ষণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। 

এখানেই কাজ শেষ হয়ে গেছে তা মনে করার কোনো কারণ নেই। আজ‌ও গবেষণামূলক নানান প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জীববৈচিত্র্যের সংকট ও তা নিরসনের সম্ভাব্য উপায় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের নিরলস চেষ্টা করে চলেছে CBD। ২০১৮ সালের ২৫ মে এই উদ্যোগের রজত জয়ন্তী বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে পৃথিবীর সমস্ত সদস্য রাষ্ট্রগুলো পার্থিব জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে তাঁদের দায়বদ্ধতার কথা পুণরায় স্বীকার করে। পৃথিবী কি বৈচিত্র্যময় এবং সেই বৈচিত্র্য কেন আমাদের কাছে এতো জরুরি তা উপলব্ধি করাই হলো এই দিনটিকে উদযাপনের একমাত্র লক্ষ্য।

এখনও পর্যন্ত ২ .১৬ মিলিয়ন প্রজাতির জৈব সম্পদের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে পৃথিবীর বুকে। এই বিপুল সংখ্যক জৈব সম্পদের মধ্যে যেমন একদিকে রয়েছে জটিল গঠন বিশিষ্ট উদ্ভিদ ও প্রাণিরা তেমনই অন্যদিকে রয়েছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব ও সাধারণ শ্রেণির জীবেরা। আজ‌ও বিপুল সংখ্যক জৈব সম্পদ আমাদের জ্ঞান বোধের চেনা সীমার বাইরে রয়ে গেছে প্রাথমিক স্বীকৃতির অপেক্ষায়। জীববৈচিত্র্য আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ কেননা পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ এক অচ্ছেদ্য বাঁধনে বাঁধা পড়ে আছে। আমরা সকলেই এই সম্পর্কের সক্রিয় ও প্রা‌ণবান উত্তরাধিকারী। একে রক্ষার দায়িত্ব তাই আমাদের সকলের। আমাদের বুঝতে হবে যে এই সতত সঞ্চারমান প্রাণপ্রবাহ ধারায় যদি কোথাও কখনো কোনো ছেদ প‌ড়ে তাহলে তা আমাদের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করবে অনিবার্যভাবে।

পৃথিবীর কোনো অংশে জীবসংস্থান খুব ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় কারণ বিকাশের উপযোগী আদর্শ অবস্থার সৃষ্টি হতে অনেক অনেক সময় লাগে, কিন্তু তার অবনমন বা বিনাশ হতে পারে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, নাটকীয় গতিতে। বিজ্ঞানীদের অভিমত আজকের জীবসংস্থান লক্ষ কোটি বছরের দীর্ঘ বিবর্তন ও প্রাকৃতিক তন্ত্রের শৃঙ্খলিত রূপান্তরের ফসল। হঠাৎ করে কিন্তু কিছুই হয়নি। অথচ এত বিপুল সময়ের নিমগ্ন সাধনার দ্বারা বিধাতা তিলতিল করে ধরিত্রীর বাগানকে যেভাবে সাজিয়েছেন তা বিগত আড়াই তিন দশকের মধ্যেই ছারখার হয়ে যেতে বসেছে। একে একে চিরবিদায়ের প্রান্তে এসে পৌঁছেছে বিবর্তনের ইতিহাসের অমূল্য স্মারকগুলি।

লিভিং প্ল্যানেট রিপোর্ট — ২০২২

২০২২ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ফান্ড ফর নেচার বা WWF তাদের সাম্প্রতিকতম লিভিং প্ল্যানেট প্রতিবেদনে জানিয়েছে যে বিগত পাঁচ দশক সময়ের মধ্যে সারা বিশ্বের স্তন্যপায়ী প্রাণি, পাখি, উভচর, সরীসৃপ এবং মুখ্যত স্বাদু জলের মাছেদের ৬৯ শতাংশ চিরকালের জন্য পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে গেছে। আজকের পৃথিবীর সামনে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হলো দুটি – প্রথমত, বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত, পার্থিব জীববৈচিত্রের অবনমন। এই মুহূর্তে এই দুটি বিষয়কে আলাদা আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই কারণ এই দুটি সমস্যা একে অন্যের সঙ্গে নিবিড় বন্ধনে আবদ্ধ। একে অন্যের পরিপূরক। 

WWF এর প্রতিবেদনে দেখা গেছে যে লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বন্যপ্রাণির সংখ্যায় ৯৪ শতাংশের মতো পতন হয়েছে। ২০২২ সালের ১৩ অক্টোবর তারিখে প্রকাশিত এই রিপোর্ট থেকে আরও জানা গেছে যে ঐ একই সময়কালের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশে তাদের পূর্ববর্তী প্রাণিসম্পদের ৬৬ শতাংশ এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৫৫ শতাংশ বন্যপ্রাণির সংখ্যা কমে গিয়েছে। পৃথিবীর নানান মহাদেশের মিঠা জলের আবাসিক প্রাণিদের ৮৩ শতাংশ চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। ভাবা যায়! এ যেন একালের গগনচুম্বী আবাসনের অবস্থা- এক ফ্ল্যাটের আবাসিক ভুলেও খোঁজ রাখেনা পাশের ঘরের প্রতিবেশীর কি হাল, কেমন আছেন তাঁরা? 

এতো বিপুল সংখ্যক প্রাণি প্রতিবেশী চিরকালের মতো ধরিত্রীর আঙিনা থেকে বিদায় নিল, অথচ আমরা খোঁজাখুঁজি তো দূরের কথা একবার তাদের কথা আলোচনাও করলাম না। সাবাস হোমো স্যাপিয়েন্স, সাবাস। নিজেদের আরও আরও বড়ো করে দেখাতে গিয়ে আমরা সৃষ্টিকর্তার তৈরি বিধিবিধানকেই নস্যাৎ করে দিতে চাইছি।আর হয়তো সেই কারণেই বারংবার প্রকৃতির রোষানলে পড়তে হচ্ছে আমাদের, ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করতে করতে ক্লান্তি এসে গ্রাস করছে আমাদের স্বস্তি, শান্তি ও সমৃদ্ধিকে।

তবে কি সন্ধ্যা আসিছে মন্দ্র মন্থরে?

কেন আজ ধরিত্রীর এই হাল ? কেন একটু একটু করে নিঃশেষিত হচ্ছে বহু মহার্ঘ্য এই প্রাণধারা ? বিজ্ঞানীরা এই বিপুল ক্ষতির কারণ হিসেবে ছয়টি বিষয়কে চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলো কৃষিকাজ, শিকার,কাষ্ঠ আহরণ, দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন এবং আক্রমণাত্মক বা ইনভেসিভ প্রজাতির আগ্রাসন। এই বিষয়গুলোর সম্মিলিত আক্রমণ পৃথিবীর জীবনের অনন্য ভাণ্ডারকে ক্রমশ‌ই শূন্য করে ফেলছে।

এই বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে WWF এর মহাপরিচালক মার্কো ল্যাম্বার্টিনি বলেছেন -

আমরা মানব প্ররোচিত জলবায়ু পরিবর্তন এবং জীববৈচিত্র্যের ক্ষতির দ্বৈত আপৎকালীন অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি । এই অবস্থা আমাদের আগামী প্রজন্মের অগ্রগতির বিষয়কে বড়ো প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

একথা মানতেই হবে যে আমরা আজ এক ক্ষয়িষ্ণু পৃথিবীর প্রায় প্রান্তসীমায় এসে হাজির হয়েছি। সামনে পেছনে এগোবার বা পিছোবার জায়গা আর নেই, অথচ আমরা এখনও স্বপ্ন দেখি,অন্যকে স্বপ্ন দেখাতে ভালোবাসি। আজ আমাদের ফেলে আসা সময়ের প্রতিটি মুহূর্তকে আতস কাঁচের তলায় ফেলে বিশ্লেষণ করতে হবে — পৃথিবী কি ছিল? পৃথিবী কি হয়েছে? আর আগামী দিনে পৃথিবীকে আমরা কীভাবে অবলোকন করবো? আজ আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপকে ইতিবাচক লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। কেননা একটি প্রকৃত টেকস‌ই ভবিষ্যতের নির্মিতির জন্য আমরা আগামীদিনে কীভাবে সম্পদের উৎপাদন করবো, কীভাবে আমরা তাকে ব্যবহার করবো, কীভাবে আহৃত সম্পদের পরিচালনা করবো, কীভাবে তাকে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের শরিক করে তুলবো সে বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে আমাদের।

এই মুহূর্তে মনে পড়ছে অভিযাত্রী স্টিভ বয়েসের কথা। এই মানুষটি তাঁর সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন আফ্রিকার ওকাভাঙ্গো বদ্বীপের বাস্তুতন্ত্র সংরক্ষণের কাজে। গভীর আক্ষেপে তিনি বলছেন, 

Wilderness cannot be restored or recreated, only destroyed. We are about to lose our last glimpses into pre- history.”

স্টিভের মতো বিজ্ঞানীদের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই কেননা তাঁরা তাঁদের নিরলস প্রচেষ্টায় আমাদের জানিয়েছেন যে কেবলমাত্র স্থূল লাভ ক্ষতির হিসেব করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় , চাই গণসচেতনতা। সরকারের দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে মানুষের জীবন ঐ পরিবেশ তন্ত্রের সাথেই যুক্ত, তাই তার বিনষ্টি মানে আমাদের অন্ত্যকাল সমাগত।

শেষ মর্মবাণী 

এক গভীর শূন্যতার হাহাকার ধ্বনিত হচ্ছে চারিদিকে। সেই বিলাপ‌কি আমার আপনার আমাদের কানে এসে পৌঁছেছে? যদি তা এসে পৌঁছায় তাহলে এখন সত্যি সত্যিই সক্রিয় হয়ে উঠতে হবে। এই সচেতনতা সৃষ্টিই হলো একমাত্র কাজ। কোনো বিশেষ গোষ্ঠী নয়,আজ চাই সর্বাত্মক সচেতনতা। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা নিজেরা এই বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারছি ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃতির অবক্ষয় , প্রাণ বৈচিত্র্যের অবনমন ইত্যাদির মতো বিষয়গুলোকে অনুভব করতে পারবোনা।

এই জঙ্গম জীবনধারার আমিও এক অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রকৃতির সঙ্কট মানে আমার‌ও অস্তিত্বের সংকট এই অনুভূতিটা মনের গভীরে লালন করা খুব খুব জরুরি। নিজেদের বড়ো ভাবতে গিয়ে আমরা নিজেরাই প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছি। আমাদের একালের জীবন, একালের যাপন প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন, কৃত্রিমতায় ভরা । আর তাই এতো সমস্যা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের সেই বিখ্যাত পঙক্তিকে আজ অন্তর দিয়ে অনুভব করার সময় এসেছে –

… বিশ্বভরা প্রাণ, তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান,বিস্ময়ে …”

আজ এই বিস্ময় ও একাত্মতাই হোক পৃথিবীর প্রাণবৈচিত্র্যকে রক্ষা করার একমাত্র অবলম্বন।

তথ্য সূত্র 

১.Why Biodiversity Matters, Nigel Dudley 

২.An Introduction to Biodiversity, Prithipal Singh 

৩.Diversity of Life, E.O.Wilson

৪. Living Planet Report 2022, WWF

লেখক সম্পর্কে

সোমনাথ মুখোপাধ্যায় একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। থাকেন পশ্চিম বাংলার উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় । দীর্ঘ তিন দশকের‌ও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করেছেন ঐতিহ্যবাহী দমদম কিশোরভারতী হাইস্কুলে। নিয়মিত লেখালেখির মধ্যেই নিমগ্ন থাকতে ভালোবাসেন। প্রিয় বিষয়: প্রকৃতি পরিবেশ , শিক্ষা। সাম্প্রতিক পরিবেশ সমস্যা তাঁকে গভীরভাবে ভাবায়। ছোট বড় সবার মধ্যে পরিবেশ সচেতনতা বাড়াতে লিখেছেন বহু নাটক। পছন্দ করেন ভাবতে ও অন্যদের ভাবাতে।

Contact email id: somnath@​6505gmail.​com